Hiranyagarbhaofficial

শ্রীশ্রীশোভামাতাজী ও নিম্বার্ক গুরুপরম্পরা

বন্দনা মুখোপাধ্যায়

(বিশ্বের একমাত্র আমার ইউটিউব চ্যানেল হিরণ্যগর্ভ অফিশিয়ালে মহান সাধিকা শোভা মায়ের সম্পর্কিত একাধিক পর্ব উপস্থাপিত হয়েছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ সেই পর্ব গুলি দেখার জন্য। কাশীর যে স্থানে উনি থাকতেন তার কনটেন্ট আপনাদের জন্য রইল। এছাড়াও একাধিক কনটেন্ট রয়েছে : JC)

নিম্বার্ক গুরুপরম্পরায় শ্রীশ্রী শোভামাতাজী ৫৬তম আচার্য্যা । শ্রীশ্রী শোভামায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী, কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে । তিনি তাঁর পিতার দ্বিতীয় সন্তান । তাঁর জন্মের সময় বাবা সুকুমার রাহা ছিলেন হবিগঞ্জের একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক । রাহা পরিবার ছিল ত্রিপুরা জেলার কুন্ডাগ্রামের এক বর্দ্ধিষ্ণু পরিবার । পরিবারটি কয়েক প্রজন্ম ধরেই শাক্ত ধর্ম্মাবলম্বী এবং বাড়ীতে ঘটা করে দূর্গাপূজা, কালী পূজা ইত্যাদি পূজা পার্ব্বণ পালন করার পরম্পরা ছিল । তাঁর বাবা সুকুমার রাহার একটি কালীমাতার পট ছিল যে পটে তিনি প্রতিদিন পূজা করে দিন শুরু করতেন । শ্রীশ্রীমায়ের জন্মের ঠিক আগে এই পট নিয়ে একটি অলৌকিক ঘটনা থেকে বাড়ীর সকলেই বুঝেছিলেন যে এই শিশুকন্যাটি অন্যান্য সকলের থেকে আলাদা । শ্রীশ্রীমায়ের মা তখন তাঁর পিতার কর্মস্থান সিলেট জেলার বানিয়াচঙ্গ গ্রামে । হবিগঞ্জে তাঁর বড় জেঠিমা একদিন স্বপ্ন দেখেন যে সুকুমারবাবুর সেই পট থেকে মা কালী একটি বাচ্চা মেয়ে হয়ে নেমে এসেছেন । বাচ্চাটিকে কোলে তুলতে যাবেন সেই মুহুর্ত্তে সুকুমারবাবু এসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে বৌদিকে বললেন – দেখুন এই পাগলী কোথা হইতে ধূলাকাদা মেখে এসেছে । স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরে সকালে উঠে বৌদি সুকুমার বাবুকে বলেন – এবার নিশ্চয়ই মেয়ে হবে । কয়েকঘন্টা পরে বানিয়াচঙ্গ থেকে ভোর চারটের সময় কন্যার জন্মগ্রহণের খবর আসে ।

শ্রীশ্রীশোভামাতাজী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সদগুরুধারার ৫৫তম আচার্য্য, শ্রীশ্রী সন্তদাস বাবাজী মহারাজের একবারে শেষলগ্নের শিষ্যা ৷ ১৯৩৫ সালে, আষাঢ় মাসে, সন্তদাস বাবাজী মহারাজ যখন কুমিল্লা গিয়েছিলেন, তখন চতুর্দশবর্ষীয়া বালিকা শোভার নাম হয়েছিল ৷ কয়েকমাস পরেই পুর্ববঙ্গ সফর শেষে, ট্রেনে কলকাতা থেকে বৃন্দাবন ফেরার পথে, ২৩শে কার্তিক, সন্তদাস বাবাজী মহারাজ দেহরক্ষা করেন ৷ অনেক সময় মনে প্রশ্ন জাগে – তিনি কি রুগ্ন শরীর নিয়ে বৃন্দাবন থেকে সুদূর কুমিল্লা গিয়েছিলেন, প্রধানতঃ এই শিষ্যাটিকে স্থূলতঃ গ্রহণ করার জন্য ? দীক্ষা দেবার পরে সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীসন্তদাসজী বলেছিলেন – “এ দেহ তো তোমাদের কতজনকেই নাম দীক্ষা দিল, এর মধ্যে যদি তোমরা একজনও সত্যিকারের মানুষ হও, তবেই আমার পরিশ্রম সার্থক”৷

শ্রীশ্রীশোভামা শ্রীশ্রীসন্তদাসজীকে প্রথম দেখেছিলেন ৬/৭ বছর বয়সে বানিয়াচঙ্গে নিজের দাদামহাশয়ের বাড়ীতে, এরপরে দ্বিতীয় দর্শন কুমিল্লায় ১৯৩৫ সালের আষাঢ় মাসে, যখন তাঁর নাম হয়েছিল ৷ শ্রীশ্রী সন্তদাসজীর কাছ থেকে তিনি স্থূলতঃ দীক্ষা পাননি ৷ দীক্ষা এবং সন্ন্যাস নিয়েছিলেন অনেক পরে ১৯৫০ সালে শ্রীশ্রীসন্তদাসজীর শিষ্য শ্রীমৎ কৃষ্ণদাসজীর কাছ থেকে । শ্রীশ্রীশোভামায়ের জীবনে সাধনপর্বের বর্ণনা পড়লে জানা যায় তিনি গুরুদেবের কৃপাধন্যা হয়ে, আপাতঃদৃষ্টিতে কঠোর তপস্যা না করেও, খুব দ্রুত সাধনপথে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন ৷ শ্রীশ্রীমায়ের ভাষায় – “প্রথম ও দ্বিতীয় দর্শন আমি পেয়েছিলাম, পাওয়া জিনিষ হারিয়ে যেতে পারেই এবং যায়ও ৷ তাই দুবারই তাঁকে পেয়ে আমি হারিয়েছি ৷ কিন্তু তৃতীয় দর্শন আমি পাইনি – তিনি দর্শন দিলেন, ঐ দর্শন আজও সরিয়ে নেননি, আজও সমভাবেই আমার কাছে বিদ্যমান আছেন”৷

শ্রীশ্রীসন্তদাসজীর কাছে নাম পাবার কিছুদিন পর থেকে শ্রীশ্রীমায়ের কাজে, কর্ম্মে ও ব্যবহারে নানা ধরণের অলৌকিক নিদর্শন তাঁর আত্মীয় ও পরিচিত মানুষজন সকলেই দেখতে শুরু করেন ৷ সব থেকে অবাক করে দিত তিনি ভোগ দেবার পরে গ্রহণের স্থূল নিদর্শন । নাম পাবার প্রায় ছয়মাস পরে, অগ্রহায়ণ মাসের এক দুপুরে তাঁর পিতা সুকুমারবাবু কোনো দরকারে বাড়িতে এসে দেখেন শ্রীশ্রীমায়ের কপালে নিপুণ হস্তে তিলক আঁকা রয়েছে ৷ শ্রীশ্রীমাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন – “দুপুরে ভোগ নিবেদন করবার সময় বাবাজী মহারাজ বললেন – এস আমি তোমার তিলক করিয়া দিতেছি ৷ আজ কাল ও পরশু আমি তিলক করিয়া দিব, তার পর থেকে তুমি নিজে করিবে”৷ মেয়ের কথা সুকুমারবাবু পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি, তাই প্রথমেই দেখতে গেলেন, তাঁর নিজের গোপীচন্দন ইত্যাদি তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছিলেন, সেইভাবেই আছে কিনা ৷ সবই ঠিকমত রাখা আছে দেখবার পর, তিনি বালিকা কন্যাকে তিলক সম্পর্কে প্রশ্ন করে জানতে পারেন, শুধু কপালে নয়, শ্রীশ্রীমায়ের শরীরের দ্বাদশ অঙ্গেও তিলক করা আছে ৷ এই ঘটনার আরো কয়েকদিন পরে, তখন পৌষমাস, জাঁকিয়ে শীত পড়েছে, হঠাৎ দেখা গেল পর পর কয়েকদিন শ্রীশ্রীমা অতি ভোরে লেপ মুড়ি দিয়ে খাটে জপ করতে বসছেন আর অল্পক্ষণ পর খাট থেকে অনেকটা উঁচু হয়ে যাচ্ছেন ৷ বসে জপ করতে করতে অত উঁচুতে উঠে যাওয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না ৷ প্রশ্ন করাতে শ্রীশ্রীমা বললেন – শেষ রাত্রে বাবা এসে ডাকেন – “পাগলী মা, ওঠ্ ৷ আমি উঠে তাঁর কথামতো জপে বসি”৷ এইভাবেই শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ তাঁর শিষ্যাকে সাধনপথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷

আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হবার কিছুদিন পর থেকেই কিশোরী শোভার সমাধি হতে শুরু করে, নানাধরণের আধ্যাত্মিক অনুভূতি, অকাট্য ভবিষ্যৎ দর্শনের শক্তি প্রকাশ পায় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, সাধনপথে উত্তরোত্তর উন্নতি করে, মাত্র ষোল বছর বয়সে তিনি পূর্ণব্রহ্মজ্ঞারূপে প্রকাশিত হন, এবং সেই বয়স থেকেই দীক্ষাদান শুরু করেছিলেন ৷ তাঁর সাধন পথের অগ্রগতি দেখে জ্যাঠতুতো ভাই ব্রহ্মচারী শিশিরকুমার মহামহোপাধ্যায় ডাঃ গোপীনাথ কবিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেছিলেন কোন্ডাগ্রামে গিয়ে শ্রীশ্রীমাকে দেখে তাঁর প্রকৃত অবস্থান কি জানাতে ৷ সেই প্রথম সাক্ষাতের পর ডাঃ গোপীনাথ কবিরাজ কাশী ফিরে গিয়ে শ্রীশ্রীমাকে লিখেছিলেন – …… তোমাকে পাইয়া যে প্রকার আনন্দ হইয়াছিল, তোমাকে ছাড়িয়া আসিয়া ঠিক তাহারই অনুরূপ বেদনা হইতেছে ৷ জানি, সে সুখ যেমন স্থায়ী হয়নাই, এ ব্যথাও তেমনি থাকিবে না ৷ কিন্তু এই উভয় অবস্থায় থাকিয়াও উভয়ের অতীত পূর্ণ সত্যে প্রতিষ্ঠিত না হইতে পারিলে সুখ দুঃখের প্রকৃত রহস্য উপলব্ধি করিতে পারা যায়না ৷ তুমি পূর্ণ ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছ, তাই তুমি পূর্ণজ্ঞান ও শক্তিতে নির্ব্বিকার ও নিশ্চল স্থিতি প্রাপ্ত হইয়াছ ৷ তোমার কোনো ইচ্ছা নাই – অথচ তুমি ইচ্ছাময়ী ৷ আমাদের ন্যায় অপূর্ণ জীবের পূর্ণত্ব সম্পাদনের জন্য যখন তোমার প্রাণ কাঁদিবে, তখন আমাদের আশা আকাঙ্খা সাফল্য মন্ডিত হইবার অবসর পাইবে ৷……

নিম্বার্ক গুরুপরম্পরায় প্রথম থেকেই শাস্ত্রআলোচনার একটা ঐতিহ্য ছিল । সেই ধারা অনুসরণ করে শ্রীশ্রী মায়ের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম প্রকাশ ১৯৩৮ সালে বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে দার্শনিক আলোচনার মাধ্যমেই ৷ গোপীনাথ কবিরাজের উদ্যোগেই তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন ও ইম্পীরিয়েল লাইব্রেরীর অধ্যক্ষ অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তর বাড়ীতে কলকাতার বহু বিশিষ্ট দার্শনিক ও শাস্ত্রবিশারদদের সঙ্গে পরিচয় হয় আর সেখানে তাঁর আধ্যাত্মিক আলাপ ও প্রশ্নের উত্তর সকলকেই চমৎকৃত করেছিল । শ্রীশ্রীমা কিন্তু খুব বেশীদিন নিজেকে শাস্ত্র আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি । তিনি গ্রহণ করেছিলেন একটি অপার স্নেহময়ী মাতৃরূপ – সে রূপের মধ্যে তাঁর দুটি সত্ত্বা – মা আর গুরু – একাকার হয়ে গিয়েছিল ।

শ্রীশ্রীমায়ের জীবনের প্রথম কুড়ি বছর কেটেছিল পিতার কর্ম্মস্থল কুমিল্লা জেলার বরকান্তা শহরে । সাধারণ গ্রাম্য বালিকা হয়েও শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক শক্তিবলে ষোল বছর বয়েসেই কুমিল্লা সিলেট থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম উত্তরে ময়মনসিংহ পর্য্যন্ত তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য তাঁর দরজা খোলা থাকতো । গুরুরূপে তাঁর প্রকাশ বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভুমিতে । সেসময়ে পর পর ঘটেছিল অনেকগুলি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি – মহামারী, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা, দেশভাগ । সেই অস্থির পরিস্থিতিতে তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল বিদগ্ধ শাস্ত্রজ্ঞরূপে নিজেকে প্রকাশ না করে কোমলা মাতৃরূপই তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের জন্য সবথেকে আশ্বাসযোগ্য এবং প্রশস্ত হবে । তাই খুব অল্পসময়ের মধ্যে নিজেকে করে তুলেছিলেন শুধুমাত্র গুরুমা নয়, ছোট বড় সকলের কাছেই জন্মদাত্রী মায়ের থেকেও আপনজন ।

শ্রীশ্রী শোভামাতাজী মমতাময়ী মায়ের মতোই সকলের সঙ্গে মিশেছেন । আদর ও ভালবাসার বন্ধনে শিষ্য ও ভক্তদের বেঁধে, একান্ত প্রিয়জনের মতো প্রতিদিনের হাসিকান্নার খেলায় অংশগ্রহণ করে, দৈনন্দিন ভালোমন্দের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতেন ৷ রোগশয্যায় তিনি রোগীর পরিচর্য্যা করেছেন, সন্তানদের স্বহস্তে রান্না করে পরিবেশন করে খাইয়েছেন, এত এত সন্তানের মধ্যে কে কি খেতে ভালবাসে কখনও তাঁর ভুল হয়নি । তাঁকে দেখেছি সন্তানদল নিয়ে যেমন আনন্দ করে পিকনিক করেছেন তেমনই তীর্থ দর্শন করতে নিয়ে গেছেন । দেখেছি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন সন্তানেরা কবে আসবে সেই আশায়, ফিরে যাবার পরে মায়ের মতোই উৎকন্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছেন পৌঁছসংবাদ পাওয়ার ৷ একবার তাঁর একদল শিষ্য-শিষ্যা বেনারস থেকে যাত্রা করেছে কিন্তু বেনারস ছাড়ার পর ট্রেন অস্বাভাবিক লেট হতে শুরু করার ফলে তারা প্রায় দশঘন্টা দেরীতে বাড়ী পৌঁছেছিল ৷ তখনও মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়নি, শ্রীশ্রীমা বেনারস আশ্রমে বসে উৎকন্ঠায় অস্থির ৷ সকলে মঙ্গলমতোই পৌঁছেচে এই সংবাদ পাবার পরে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – তিনি তো সর্বজ্ঞা, তাহলে এত উৎকন্ঠা কিসের জন্য ? শ্রীশ্রীমা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন – “আমি খুব ভাল এ্যাক্টিং করতে পারি, তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে বোধহয় ওভারএ্যাক্টিং করে ফেলি ৷ কিন্তু বলো, মা কি সন্তানের জন্য চিন্তা করবে না ? তোমাদের সব ভালমন্দের দায় তো আমারই”৷

নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের গুরুপরম্পরায় আচার্য্যগণ সকলেই এইভাবে নিজেদের যোগ ঐশ্বর্য্য গোপন করে একটি ব্যবহারিক রূপ তৈরী করে নিতেন জনসমক্ষে প্রকাশিত থাকার জন্য, আর তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকাশ পেতো তাঁদের গুরুরূপ ৷ শ্রীনিম্বার্ক ভগবান দিকবিজয়ী শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও থাকতেন অতি সাধারণ বিনয়ী বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর মতো । কেশব কাশ্মীর ভট্টাচার্য্যের জীবনী থেকে পেয়েছি তিনি কাশ্মীরে পৌঁছে সাধারণ সন্ন্যাসীর মতো গাছতলায় আশ্রয় নিয়ে তাঁর গোপালজীর বিগ্রহ স্থাপনা করে পূজা করেছিলেন । কাঁসর ঘন্টা, শাঁখ ইত্যাদির শব্দে বিরক্ত হয়ে কাশ্মীরের নবাব যখন পূজায় বাধা দিতে গিয়েছিলেন তখন কেশব কাশ্মীরিজী নিজের যোগ ঐশ্বর্য্য প্রকাশ করেন, তাঁর শক্তি দেখে ভীত হয়ে নবাব তাঁর পায়ে পড়ে শরণ নিয়েছিলেন । শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজের জীবনচরিত থেকে জানা যায় তাঁর গুরুদেব দেবদাসজী মহারাজ দেখাতেন এক উগ্রমূর্ত্তি কঠোর রূপ । রামদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ নিজে সহজ সরল শিশুবৎ আচরণ দিয়ে নিজের অন্তর্দর্শী সত্তাকে ঢেকে রাখতেন, সন্তদাস বাবাজী মহারাজকে দেখে মনে হতো এক সৌম্য, স্নিগ্ধ, তত্ত্বোপদেশক আচার্য্য ৷ শ্রীশ্রীশোভামা আমাদের কাছে এসেছিলেন এক অনন্যা করুণাময়ী মাতৃরূপে, যে রূপের আড়ালে ঢাকা থাকতো তাঁর যোগৈশ্বর্য্য ৷

তিনি নিজে পরিচয় না দিলে তাঁর গুরুসত্ত্বা চেনা সম্ভব ছিল না ৷ ঠিক যখন ভাবছি তিনি আমাদেরই মতো একজন, তখনই দেখেছি সামান্য ছোট্ট ঘটনা অথবা কথার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে তাঁর অধ্যাত্মিক সত্ত্বা সামনে এসেছে, মনে করিয়ে দিয়েছেন মাতৃরূপ শুধুমাত্র তাঁর লীলা ৷ একটা ঘটনার উল্লেখ করছি – একবার বেনারস আশ্রমে পূজার সময়ে অনেক শিষ্য শিষ্যা এসেছে, সকলেরই ইচ্ছা একদিন গুরুমায়ের সঙ্গে সবাই মিলে গঙ্গায় নৌকাবিহার করতে যাবে ৷ কত টাকা লাগবে, কার কত দিতে হবে, সেই হিসাব করা হচ্ছে, এর মধ্যে শ্রীশ্রীমা নিজেই হঠাৎ সেখানে উপস্থিত ৷ নৌকাবিহারের কথা শুনে তিনি সম্মতি দিয়ে বললেন – “নৌকার খরচা আমি দেবো, পার তো আমাকেই করতে হবে, তাই এই দায় আমারই”৷

নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের আচার্য্যদের উপদেশাবলী পড়ে জানতে পেরেছি তাঁরা প্রত্যেকেই সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন, অনেকেই জনসমক্ষে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে ভালবাসতেন । প্রথম দ্বাদশ আচার্য্য শাস্ত্রবিচার করার জন্য বিদ্বৎসমাজে পরিচিত হলেও সাধারণ মানুষের সামনে খুব একটা আসতেন না । সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই পরম্পরার যোগ শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ ভট্টনদের সময় থেকে । যেমন যেমন জনসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছিল তখন থেকে তাঁরা সময়ে সময়ে পরম্পরাগত সাধন প্রণালীও প্রয়োজনমতো সহজ ও যুগোপযোগী করে তুলেছিলেন ৷ আধুনিক সময়ে শ্রীশ্রী সন্তদাসজীর উৎসাহে নিম্বার্ক ধারার সাধন পথে নারীশক্তির বিকাশ আরম্ভ হয় ৷ তাঁর আগে পর্য্যন্ত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী দীক্ষা গ্রহণ করতেন, তিনি নিজেও সস্ত্রীক দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর শিষ্যাদের মধ্যে অনেক মহিলা ছিলেন যাঁরা সম্পূর্ণরূপে নিজের ইচ্ছায় সাধন পথে এসেছেন ৷ তাঁর পূর্বাশ্রমের ধর্ম্মপত্নী অন্নদাদেবীকে তিনি গুরুমাতারূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের কাছে অন্নদাদেবী মাতৃসমা আচার্য্যা ছিলেন ৷ সন্তদাসজী কন্যাসমা আত্মীয়া গঙ্গাদেবীকে শাস্ত্রজ্ঞানে পারদর্শী করেছিলেন ৷ পরবর্ত্তীকালে পঞ্চতীর্থ গঙ্গাদেবী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া আচার্য্যারূপে পরিচিত হয়েছেন ৷ শ্রীশ্রী সন্তদাসজীর সর্বকনিষ্ঠা শিষ্যা যাঁকে তিনি অলৌকিকভাবে যোগ্য করে তুলে আচার্য্যারূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি আমাদের গুরুমা শ্রীশ্রী শোভামাতাজী ৷

গুরুপরম্পরার ধারা অনুসরণ করে শ্রীশ্রীশোভামা যদিও নিজের আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পূর্ণরূপে প্রচ্ছন্ন রাখতেন, ক্কচিৎ কখনো প্রকাশ হয়ে পড়তো তাঁর সাধনলব্ধ অপার শাস্ত্রজ্ঞান ৷ সেই সব প্রশ্নোত্তর পর্বে কখনও কখনও পেয়েছি তাঁর অলৌকিক শক্তির ঝলকও ৷ ষাটের দশকে এক মাদ্রাজী ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্রীশ্রীমায়ের কাছে ৷ ভদ্রলোক সুপন্ডিত, উপনিষদের কিছু ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে তাঁর শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে আসা ৷ ভদ্রলোক প্রথমে কিছুক্ষণ দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলার পরে শ্রীশ্রীমার কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করেন – তিনি দোভাষী নিয়ে কথা বলে আরাম পাচ্ছেন না, মা কি তাঁদের মধ্যে ভাষার অন্তরাল তুলে দিয়ে কথা বলতে পারবেন ?
শ্রীশ্রীমা একটু হেসে উত্তর দিলেন – আপনি যে ভাষায় সব থেকে সুবিধা পান কথা বলতে, সেই ভাষায় বলুন না –
এর পরে ভদ্রলোক তামিল ও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে গেলেন ও শ্রীশ্রীমা পরিষ্কার বাংলায় উত্তর দিতে লাগলেন ৷ এইভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক আলোচনা চলেছিল ৷ তাঁর সমস্ত প্রশ্নের ও দ্বন্দের সমাধান পাবার পরে তিনি শ্রীশ্রীমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বারবার বলেছিলেন – তিনি নিশ্চয়ই পূ্র্ব্ব পূ্র্ব্ব জন্মে বহু সুকৃতী করেছিলেন তাই এত মহান এক সাধিকার দর্শন পেলেন ৷

শ্রীশ্রীমা নিজেই বলতেন তিনি বই পড়ে শাস্ত্রজ্ঞ হননি, আধ্যাত্মিক ঔৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রজ্ঞান তাঁর মধ্যে উন্মোচিত হয়েছিল ৷ লৌকিক অর্থে শ্রীশ্রীশোভামা সুশিক্ষিতা ছিলেন না কিন্তু পুঁথিগত শিক্ষার অভাব তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অন্তরায় হয়নি ৷ সন্তদাসজীর মধ্যে যে জ্ঞানমিশ্রিত ভক্তির অপরিসীম ফল্গুধারা দেখা যেত, শ্রীশ্রীশোভামার মধ্যে তারই প্রতিফলন দেখেছি শিষ্য, শিষ্যা, ভক্ত ও অনুসন্ধিৎসুদের সঙ্গে তত্ত্ব আলোচনা করার সময়, বিশেষ করে যখন তিনি দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতেন ৷

একটা কথা নিম্বার্ক গুরুপরম্পরার প্রত্যেক গুরুর উপদেশেই পাই – নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সাধনা মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে । সেই কারণে এই পরম্পরার সাধন পথ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ, ধৈর্য্য ও নিষ্ঠা সহকারে এই পথে চলতে হয় ৷ ভক্তের আকুলতার মধ্যে দিয়েই গুরুকৃপা প্রবাহিত হয় । কথাপ্রসঙ্গে অনেকবারই শ্রীশ্রীমা বলেছেন – উৎসবাদিতে গুরুপরম্পরা উপস্থিত থাকেন । তখন প্রশ্ন করা হয়েছিল – তাঁরা তো সবাই সিদ্ধপুরুষ, বহুদিন আগে স্থূলদেহ পরিত্যাগ করেছেন, তাহলে কি করে উৎসবে উপস্থিত থাকেন ? তিনি বুঝিয়ে বলতেন – “শক্তিরূপে । এইজন্য বলি উৎসবে আসার চেষ্টা করো, তখন গুরুপরম্পরার আশীর্ব্বাদ পাওয়া যায়”। তিনি আরও বলতেন – “তোমরা যে মন্ত্র পেয়েছ সেই মন্ত্রে পূর্ব্বপূর্ব সময়ে আচার্য্যরা সিদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের গুরুশক্তি মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তোমাদের শরীর মনে প্রবাহিত হচ্ছে, প্রতিটি মন্ত্র সিদ্ধ ও পরম শক্তিমান ।

গুরুপরম্পরার সাধনপথ সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে শ্রীশ্রীশোভামা একবার বলেছিলেন – “দেখ যুগের সাথে সাথে কত পরিবর্তন হয়েছে সাধনপথের ! শ্রীশ্রী দেবদাসজী মহারাজের সময়ে শাসন এবং সাধনভজনের যে কঠোরতা ছিল, শ্রীশ্রীকাঠিয়াবাবাজী মহারাজ সেই কঠোরতা আপন শিষ্যদের মধ্যে সকলের প্রতি প্রয়োগ করেননি ৷ আবার বাবাজী মহারাজের আমলে সাধনের কঠোরতা এবং আহারের নিয়মাদি তিনি আরও সহজ করে দিয়েছিলেন ৷ এখন আমরা সেই নিয়মাবলীও সম্পূর্ণ মানতে পারি না ৷ ভবিষ্যতে হয়ত আরোও সহজ করে নিতে হবে । তার একটা কারণ অবশ্যই পূর্বের কঠোরতা এখন আমাদের শরীর এবং মনের গ্রহণ করারই শক্তি নেই”৷ এই প্রসঙ্গে বারে বারে কথায়, চিঠিপত্রে, তিনি বলেছেন – “জীবনে চলার পথে প্রতি পদক্ষেপেই যাতে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে পারো, সেই চেষ্টা করবে । ভগবানকে পাওয়ার জন্য সংসার ছেড়ে বনে-জঙ্গলে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই । যে যেখানে আছ, সেইখানেই তাঁকে পাবে, যদি মন-প্রাণ নিবিষ্ট করে তাঁকে ডাকতে পার । কারণ তিনি তো সর্বত্রই আছেন । সর্বভূতে, সর্বজীবে সেই তিনিই আছেন জেনে সর্বতোভাবে তাঁকে সেবা করো । তোমার পতি, পুত্র, পত্মী, কন্যা, সর্বরূপেই তিনি । সংসারটা আমার মনে না করে মা’র মনে করিও, তবেই সংসার বন্ধনের কারণ না হয়ে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । কলিকালে জীব স্বল্পায়ু, কাজেই সদাই লক্ষ্য রাখবে জীবনের সময় যেন বৃথা না যায় । জীবনকে করতে হবে ভগবৎমুখী । মনকে করতে হবে – নামময় । নামকে প্রিয় থেকে প্রিয়তম করো – বিষয়ী লোক যেমন বিষয়কে ভালবাসে, তেমনি নাম-কে ভালবাসতে শেখ । যে নাম দিয়েছি, এভাবে করে যাও, দেহের প্রতি অণু-পরমাণু যেন নামময় হয়ে ওঠে”।

১৯৫০ সালে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তিনি বলেছিলেন – “আমার নিজের জন্য সন্ন্যাসের কোনো প্রয়োজন ছিলনা, কিন্তু আমার শিষ্য শিয্যাদের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হতে কোনো বাধা যেন না আসে সেই জন্যই আমার সন্ন্যাস গ্রহণ”।

নিজের কর্ম্মস্থান হিসাবে শ্রীশ্রী শোভা মা বেছে নিয়েছিলেন হিন্দুধর্ম্মের ঐতিহ্যময় কেন্দ্রস্থল বেনারস । সেখানে তিনি ১৯৫২ সালে একটি মেয়েদের আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । আশ্রমের নাম রেখেছিলেন তাঁর গুরুজীর নামটিকে শাশ্বত করে “সন্তআশ্রম”। পরবর্ত্তীকালে ষাটের দশকে কলকাতার কাছে কল্যাণীতে ছেলেদের জন্য আর একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন ।

নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু শ্রীহংস ভগবান সনকাদি ঋষিদের বলেছিলেন – “একমাত্র গুরুই জিজ্ঞাসুকে পরিতৃপ্ত করতে পারেন, তাই আমি তোমাদের কাছে গুরুরূপে এসেছি । আমার এই প্রকাশের মাধ্যমে গুরু-শিষ্য পরম্পরার সৃষ্টি হবে, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও আত্মতত্ত্ব জীবলোকে প্রচারিত হবে ও শরণাগত মুমুক্ষু মানুষ কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির পথ জানতে পারবে”৷ সেই পরম্পরার মূর্তরূপ শ্রীশ্রীশোভা মা । তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মের শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, শিষ্য ও ভক্তদের নিষ্কাম কর্ম্ম করার পথ দেখিয়েছেন, নিজের দৈনন্দিন জীবনধারা দৃষ্টান্ত করে তুলে ধরে, সাধনার পথ একটা সহজ নিয়মে বেঁধে দিয়েছিলেন । তিনি বারে বারে বলেছেন – “গুরুপরম্পরার অফুরন্ত শক্তি আমাদের মধ্যে আছে, যা দিয়ে শেষ করা যায়না ৷ কিন্তু সত্যিকারের শিষ্যত্বের ভিতর দিয়ে তা আকর্ষণ করে নেওয়া যায়”৷

১৯২১ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বমুহুর্ত্তে তাঁর জন্ম আর ২০০৪ সালে ৩১শে অক্টোবর মাসে, বেনারস সন্ত আশ্রমে, সূর্য্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ইহজগতের লীলা সমাপ্ত হয়েছিল । অদ্ভূতভাবে ঠিক সেই সময় পুরো বেনারস শহরে ইলেক্ট্রিসিটি সরবরাহ এক ঘন্টার মতো বন্ধ হয়ে যায় ।